সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯
পত্রে প্রথম প্রেম
মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৯
ফিরে এসো না প্রিয়তমা
শনিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৯
স্মৃতিচারণ
মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৯
নোটবুক
নোটবুক ব্যাবহারের ইতিহাসটা অনেক আগের যখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়তাম, তখন থেকে। আজকালকার ভার্চুয়াল সামাজিক গণমাধ্যমগুলি তখনো এতটা বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি। সেই সব দিনগুলিতে মনের অনুভতিগুলি নোটবুকেই জমা থাকত। এখন যেমন শোবার ঘরের খবর পাবলিকের কাছে পৌছে যায় তখন ঠিক এর উল্টোটা ছিল। যেগুলো হয়ত বন্ধুদের কাছে বলার মত ছিল সেগুলিও নোটবুক দখল করে রাখত। কোনভাবে নোটবুক অন্যের হাতে পড়া মানে সাধারণত একটা বিব্রতকর অবস্থার জন্ম দিত। আমি যদিও কখনো সে দলের সদস্য ছিলাম না। বরং, এখনকার মত আমার সিক্রেটগুলিও হত ওপেন-সিক্রেট। এটা আমি করতাম যেন এতে অন্যদের আগ্রহ কম থাকে। সত্যি বলতে কি, ছোটবেলা থেকেই মানুষের সাইকোলজি বুঝতে চেষ্টা করতাম। দেখা গেল কয়েকদিন টেবিলে রাখা নোটবুক প্রথম কয়েকদিন নাড়া করে সমবয়সীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এরপর অনেককিছু লেখা এ নোটবুক সাবার সামনেই নির্লিপ্তভাবে পড়ে থাকত। আরও একটা বিষয় ছিল। আমি সরাসরি কিছু লেখাতাম না। নিজের সব গল্পগুলিই ছোটগল্প কিংবা কবিতায় মিশে থাকত। কবিতা বা গল্পের বিচারে যতই খারাপ হোক আমি তো জানি গল্পের পেছনের মানুষটি আমি, আমার সত্ত্বা কিংবা আমার সচেতন বা অবচেতন মনের কামনা-বাসনা-কল্পনা।
আমার নোটবুকে শুধু যে আমার নিজের লেখা থাকত তা কিন্তু নয়। প্রিয়-অপ্রিয় অনেকের লেখাও মাঝে মাঝে এসে গেছে। কেউ চুরি করে, কেউ জোর করে লিখেছে, আবার কাউকে অনুরোধ করেছি কিছু লেখার জন্য। এর মাঝে কতগুলি লেখার কোন হদিস একযুগেও পাইনি। একটি নোটবুকের চিরকুটে কে যেন লিখে দিয়ে গেছে,
"ভুল করে যদি কোন দিন, মনে পড়ে আমায়"
আমার প্রতি যাদের মোহ কিংবা আবেগ ছিল, যারা যারা লিখতে পারে সন্দেহ করা যায় তাদের প্রত্যেকে জেরা করা হয়েছে। কেউ স্বীকার করলনা।
আজ বার বছর পর আরেকটি নোটবুকে আরেকটি লেখা চোখে পড়ল যেখানে এক বালিকার নাম লেখা। তারপর লিখা, "দুজন দুজনকে ভালবাসি।" লেখাটি আমার নয়। কে লিখেছে জানিনা। তবে এটুকু জানি যে বালিকার নাম লেখা সে বালিকা এখন কারো ঘর সামলাতে ব্যাস্ত। বছরখানিক আগে তার সাথে শেষ বারের মত যখন দেখা হয়েছিল, স্বামী বাড়ি ছিলনা। তার কাছ থেকেই জানলাম, পরহেজগার স্বামী, খুব পর্দা মানেন, স্ত্রীর যত্ন নেন। "পুরাতন প্রেমিকের সাথে কথা বলছ শুনলে তো বেচারা হার্ট এ্যাটাক করবে" বলে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসেছিলাম। দূর এসে ফিরে দেখি বারান্দার একটি বাশের খুটি ধরে ভেজা চোখে সে কাঠমূর্তির মত ঠায় দাড়িয়ে আছে। আমি আর তাকালাম না। যে পিছনে পড়ে যায় তার দিকে ফিরে তাকানো আমার স্বভাবে পড়েনা।
নোটবুক খুললে এরকম গল্পে অসংখ্য চরিত্র সামনে এসে পড়ে। কারো গল্প এক পৃষ্ঠাতেই থমকে গেছে, কারো অস্থিত্ব কয়েকটি নোটবুক জুরে কিন্তু সবগুলি গল্পের সারমর্ম এক।
নোটবুকের এই গল্পগুলি পেছনে পড়ে গেছে। ভার্চুয়াল সামাজিক মাধ্যমের যুগে নোটবুক আজ কেবলই পিছনে পড়ে থাকা একটা ইতিহাস।
বুধবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৯
সে যায় দূরে
সে যায় দূরে
তবুও পেছন ফিরে
তাকায় কেন ধীরে?
আমি নিরবে মরে
থাকি চুপ করে
কিন্তু ক্ষণিক পরে...
নিরাশা যে বাড়ে
ফিরে না'ক নীড়ে
ফের যায় দূরে।
উৎসর্গঃ তৃষা
শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৯
মরিচীকা প্রণয়
সে ঠিক সামনে
দাড়িয়ে আছে আনমনে
তবুও খুজে পাইনে
চলে আসি দূরে
ইট পাথরের নীড়ে
কাল বহে ধীরে
চোখ বুজে শেষে
খুজি ভিন দেশে
সতী বেহুলার বেশে
আমি মরে একবার
বেচে উঠে নিঃসাড়
সামনে যাই আবার
সে ঠিক সামনে
দাড়িয়ে আছে আনমনে
তবুও খুজে পাইনে
চলে আসি...
.....
(চলতেই থাকবে)
শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৯
মুক্তি
অনেকদিন পর মায়াবতীর সাথে দেখা।
কাকতালীয় বলা ঠিক হবে জানিনা। যে বাড়িতে তার বর্তমান বাস বাড়ির রাস্তা দিয়ে আমার নিত্য যাওয়া আসা কিন্তু সে চারদেয়ালে আবদ্ধ আর আমি মুক্ত বিহঙ্গ। এখন আমি আর উকি দিয়ে তার খোজ করিনা। সেও আগের মত আমাকে খোজিয়া বেড়ায় না। তার নিকট আত্মীয়কে বিদায় দিতে বাড়ির মূল ফটকে আসা। হয়ত এর আগেও এসেছিল। গানিতিক সম্ভাব্যতার ধাধাগুলিকে সত্যি প্রমাণ করে দিতেই তার সাথে দেখা হয়ে গেল।
-এই 'হাফ লেডিস'?
আমার মাঝে পুরুষত্বের কমতি ছিলনা কখনোই। তবুও কোন কারণে আমাকে 'হাফ-লেডিস' বলে বিব্রত করতে পারলে তার ঠোঁটের কোণে এক চিমটি হাসি ফুটে ওঠে। সে দিনগুলি অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। আমি যথাসম্ভব না শুনার ভান করে এড়িয়ে যাওয়া চেষ্টা করলাম। জায়গায় দাঁড়িয়েই পরেরবার জোরে চেচিয়ে ডাক দিল। এবার আসল নামেই ডাকল সে।।
-অপুদা'
আমার সাথে থাকা ব্যাক্তিগত সহকারী বলল, স্যার আপনাকে ডাকছে।
এরপর আর এগিয়ে যাওয়া যায়না। আমি পিছনে ঘোরে চিরায়িত সেই হাসি দিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। বললাম,
কেমন আছ?
-ভাল। আপনি?
-ভাল।
মিনিটখানিক সময় চুপচাপ দাড়িয়ে ছিলাম। আর কোন প্রশ্ন খোজে পাইনি। হয়ত সেও না। বললাম, চলি।
সে বলল, একমিনিট দাড়ান।
সে ছুটে গেল ভিতরের দিকে। দুই তিন মিনিট পর ফিরে এসে বলল, "ভিতরে আসুন।"
ভেবেছিলাম, 'এখন না' বলে চলে আসব। কিন্তু তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, "চলো। মাত্র দুই মিনিট কিন্তু।"
তাকে ফলো করে করে তার একটা রুমে ডুকলাম। সে ব্যাস্ত হয়ে আপেল, মাল্টা কেটে সামনের টেবিলে রাখল। মফস্বলে লিভিং, ডাইনিং কিংবা বেডরুম বলে আলদা কিছু নেই। একটা বেডরুমে দুইটা সোফা ফেললে সেটাই অতিথিদের জন্য লিভিং হয়ে ওঠে। এ ঘরে প্রথমবারের মত আসা। আগের বাড়ির রুমের সাথে তফাৎ খালি চোখেই আলাদা করা যায়। রুমটা মাত্রই গোছানো হয়েছে। বিছানায় একটি বাচ্চা ঘুমোচ্ছে। একদিকে একটি দোলনা অন্যদিকে ফ্রিজ, ড্রেসিং, শোকেসে সাজানো একটি পরিপূর্ণ মধ্যবিত্তের রুম।
বিছানায় ঘুমানো বাচ্চাটার দিকে চেয়ে বললাম, বাবুর বাবা কোথায়?
-বাইরে।
-যাক, বাচা গেল। বেচারা যদি দেখে তার বউ পুরোনো প্রেমিকের সাথে কথা বলছে সেটা মোটেও ভাল হতনা।
-ও, সব জানে।
-তারপরও সেটা অতীত। বর্তমান নিয়েই চল। অতীতের সব ভূলে যাও।
-হ্যা, কি আর করা।
যেন অসহায় আত্মসমর্পণ করছে সে। বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করার ক্ষমতা তার নেই আজ। আমার তো কখনোই ছিলনা। না সেদিন, না আজ।
সে কখনোই খুব বেশি কিছু চায়নি। যেটুকু চেয়েছে সেটুকুও পায়নি।
আমি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে একাই বকবক করছিলাম। তার করুণ আখিই বলে দিচ্ছিল সে কিছু বলতে গেলে জল বাধ ভেঙে বেড়িয়ে আসবে। আজকের দিনের জন্য তার কোন দায় ছিলনা অথচ সে নিজেকে অপরাধীর আসনে বসিয়ে রেখেছে।
আমি গোগ্রাসে কয়েক টুকরো ফল খেয়ে বললাম, এবার তাহলে চলি।
আমার সহকারীর দিকে তাকিয়ে বলল, "উনি তো কিছুই খেলেন না।"
আমি বলার পরও সহকারী বসের সামনে কিছু খাওয়ার দুঃসাহস দেখাল না।
আসার সময় বললাম, একটা কথা বলি?
-বলুন।
আমি কিন্তু অন্য কারো সাথে বাজি ধরে তোমার কাছে এসেছিলাম।
-সে কি এখন তোমার হয়েছে।
-হ্যা, আমারা সুখে আছি। শীঘ্রই ঘরে বিয়ের কথা বলব।
-মেনে নিবে?
-জানিনা, না হলে দেশ ছেড়ে পালাব৷ তার যদি না হতে পারি তবে আর কারো হব না।
এই বলে পথ ধরে এগিয়ে আসলাম। একসময় রাস্তার বাকে হারিয়ে গেল মায়বতীর চোখ। কিছু দূর যাওয়ার পর সহকারী জিজ্ঞেস করল, সত্যিই কি আপনি কারো সাথে বাজি ধরে ম্যাডামের কাছে এসেছিলেন?
আমি হাসলাম। মানুষ যখন কোথাও আটকে যায় তখন তাকে মুক্তি দিতে হয়। আমি অন্য কারো জন্য তার কাছে এসেছিলাম জানার পর তার আর আমার জন্য অপরাধের বোধ কাজ কবরেনা। তার চোখের গভীরে লুকিয়ে থাকা অশ্রুবিন্দুটুকু মুছে যাবে।
সে এখন নিজেকে নতুন অনাগত ভবিষ্যতের জন্য মুক্তি দিবে।
সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
এপিটাফ
চাঁদ যদি বলে
নীল জ্যোস্না তোমার নয়
আকাশ যদি বলে
শুভ্র মেঘ তোমার নয়
রাত যদি বলে
নিঃসঙ্গ ধ্রুবতারা তোমার নয়
কিংবা
ঘাস যদি বলে
স্নিগ্ধ সবুজ তোমার নয়
নদী যদি বলে
নিরব মোহনা তোমার নয়
পৃথিবী যদি বলে
জীবনী নিঃশ্বাশ তোমার নয়
তখন আমি কি করব?
আমি কি হারিয়ে যাব,
নাকি বিদ্রোহ করব
নাকি মিনতি?
নদী আর আকাশের কাছে
এই রাত, চাঁদ কিংবা স্নিগ্ধ সবুজের কাছে
অথবা নির্মম এই পৃথিবীর কাছে
তোমাকে নিয়ে শরতের আরও একটি ভোর দেখার জন্য
শিশির ভেজা ঘাসে এক জোড়া পদচিহ্ণ একে দেয়ার জন্য
কিংবা, পৃথীবিতে আরও একটুখানি কার্বণ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য।
শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
বহুদিন তোমায় খুজিনা
বহুদিন তোমায় খুজিনা।
হয়তবা পাশেই ছিলে
শাশ্বত নৈশ কিংবা হিজলের বনে
বাতাবিলেবু, আম কিংবা কাঠালের ঘ্রাণে
শিউলী ফুলের সুবাস টানে।
হয়বা পাশেই ছিলে
ছায়া বৃক্ষের পাতা হয়ে
জ্যোৎস্না রাতের মায়া ছুয়ে
মোহনার মত নীরবে বয়ে
কিংবা হয়তবা পাশেই ছিলে
চলন বিলের জলখেলায়
রক্তরাঙা আবির অবেলায়
বেহুলার আশার ভেলায়।
হয়তবা পাশেই ছিলে,
বহুদিন তোমায় খুজিনা।
তোমি কি এমন করেই পাশে থাক
না কি খুজিয়া বেড়াও অন্য ঘোরে?
পথের ধারে
কিংবা অচেনা কোন এক নদীর তীরে।
#বহুদিন_তোমায়_খুজিনা
অবুঝ পান্ডুলিপি
নিজের পাশে হয়তো কখনো কাউকে চেয়েছিলাম
হয়ত কোন এক মায়াবতী, বিপরীত স্বাভাবের
ঠিক কি চেয়েছি সেটা কখনো বুঝে উঠতে পারিনি;
সৃষ্টিকর্তা বুঝার সে ক্ষমতাটা আমাকে দেয়নি।
সবুজ ঘাস কিংবা পাথুরে দেয়ালের পথ ধরে হাটি,
হাটি আর ভাবি, কি চাই আমি?
হঠাৎ কোন এক মায়াবতীর লাজুক চোখে থমকে যাই
মনে হয়...... মনে হয়
"তাকেই তো আমি খুজছি,
ঠিক এমন একজন
যেমনটা আমি চাই।"
সময়ের সাথে আতশী কাচের নিচে পর্যবেক্ষণ করি
বেরিয়ে আসে কতগুলি অসম্পূর্ণতা।
দিন শেষ কিসের আকাঙ্খাকাটা যেন থেকেই যায়
ঠিক কিসের আকাঙ্খা
মনে হয় কখনো বুঝে উঠতে পারি,
কখনো বুঝে উঠতে পারি না।
আসলেই আমি কি চাই
সেটা কখনোই বুঝতে উঠতে পারিনা।
একটা চাপা অভিমান কাজ করে
কখনো নিজের প্রতি
কখনো ভগবানের প্রতি।
পরমেশ্বর নিজেকে বুঝার ক্ষমতাটা আমাকে দেয়নি।
.
#অবুঝ_পান্ডুলিপি
ইতিহাসঃ ডাস্টবিনে ফেলে দেয়ার সময় হঠাৎ দেখি একটা ছেড়া কাগজে দেখি কি যেন লেখা। হাতের লিখাটা আমার কিন্তু ঠিক কবে লিখা মনে করতে পারছিনা।
মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই, ২০১৯
তৃতীয় একজন
আমি যে চায়ের দোকানটিতে বসে আছি সেটা ছোট শহরের গলিতে থাকা আর দশটা চায়ের দোকানের মতই। মূল শহর থেকে খানিকটা দূরে শহরতলীতে নিম্ন মধ্যবিত্তদের আবাসিক এলাকায় কোনক্রমে দাড়িয়ে থাকা অর্ধস্থায়ী সে দোকানের অনিয়মিত এক কাস্টমার আমি।
এসব দোকানে অন্য এলাকার রিক্সাওয়ালা, নতুন বাড়ির সন্ধানে আসা বাড়াটিয়া, রাস্তা ভূলে বা বেড়াতে আসা কিছু আগুন্তক ছাড়া বাকী সবাই পরিচিত মূখ।
সকাল-বিকাল গার্লস স্কুল ছুটির সময় এলাকার যুবকদের প্রিয় হয়ে দোকানটি বাকীটা সময় নিষ্কর্মা গুটি কয়েক বৃদ্ধদের দখলেই থাকে। তাদের আড্ডা সুবোধ চ্যাটার্জির অবাধ্য বউ থেকে শুরু হয়ে ক্রিকেটের মাঠে মুস্তাফিজুরের আউটসুইং হয়ে আমেরিকার বুশ পর্যন্ত ঠেকে।
.
এইসব সাধারণ চরিত্রের বাইরেও আরও একজন থাকে এই দোকানে। বয়সের দিক থেকে যুবক হলেও গার্লসস্কুলের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। একটি বই হাতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে। ইতিহাস, বিঞ্জান আর শিল্পেকলার বাহারী বই দেখে বোঝার উপায় সে আসলে কি নিয়ে পড়াশোনা করে বা আদৌ কোন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে কি না। তবে পড়া যে তার খুব প্রিয় এ নিয়ে সন্দেহ করার আবকাশ নেই। দোকানদারের খুবই প্রিয় পাত্র। তার কাছে দোকানে দায়িত্ব দিয়ে দুপুরের স্নান আহার কিংবা দুপুরে বাজারের দিকে একবার চক্কর দিয়ে আসা যায় সহজেই।
.
হ্যালির ধূমকেতুর মত আমি নেহাত শশুরবাড়ি আসলে আমিও ক্ষণিকের জন্য দোকানের অংশ হয়ে যাই। ঘরে বানানো চা থেকে ছোটখাট এসব দোকানের চা-ই আমাকে বেশি টানে।
.
চুপিসারে বিয়ের কাজ শেষ করার পর দুই বছরে এখানে আমার তিন বার আসা। আমি ছোট হাসি দিয়ে "কেমন আছেন" বলে হাত বাড়িয়ে দিলাম।
-"এই তো ভাল, আপনি?" বলে সেও হাত বাড়িয়ে দিল। খানিকটা অস্বস্তিবোধও করছে। বুঝলাম, কোন এক কারণে সে আসলে আমাকে খুব ভাল করে চিনে কিংবা লোকটির স্মৃতি শক্তি ততটা ভাল নয় হয়ত নতুবা কে জানে, হয়ত খেয়াল করে আমাকে দেখেনিও কোন দিন।
.
ব্যাপারটা আমার কাছেও অস্বস্তিকর। খোলাসা করে বলে দিলাম, "আমিও আগেও দু এবার এখানে চা খেতে এসেছি। প্রত্যেকবারই আপনাকে দোকানে দেখেছি। চা কি আপনার খুবই প্রিয়?"
সে বলল, "চা এতটা প্রিয় না হলেও, দোকানটি প্রিয়।"
আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। চা প্রিয় নয় কিন্তু দোকানটি প্রিয়। আমি বেশ কৌতূহল বোধ করলাম, "মানে?"
-"না আসলে ঐ যে ঈশান কোনে যে বাড়িটি দেখছেন সেটির দুইতালার বেলকুনি আর তার পাশের জানালাটি আমার প্রিয়। এজন্যই এখানে বসা।"
এ তো আমার শশুর বাড়ির বাসা। এসব কিছু বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করলাম,
-কেন?
- কখন কিভাবে জানিনা, হঠাৎই নিজের ভিতর হৃদস্পন্দনে একজনকে অনুভব করতে শুরু করেছিলাম। সকালে গুন গুন করে সে পড়তে বসে আমি দূর থেকে যেন সঙ্গীতের রাগ-রাগীনি খুজে পাই। দুপুরে তার সিক্ত চুলে আমি স্নিগ্ধতা লাভ করি। রাতে নিয়ন আলোয় তার ছায়ায় আমি দূর্নিবার এক মায়া উপলদ্ধি করতে থাকি।"
-তারপর
- বেশি ভালবাসা একটা পর্যায়ে বাস্তব যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। এতটাই বেশি যে, সে মানুষটির সামনে দাড়াতেই ভয় হয়। আমি কখনো তার কাছ থেকে না শুনতে চাইনি। তার মুখ থেকে না শুনার পর পৃথিবীতে নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে হবে। হয়ত বেচে থাকাটাই বিস্বাধ লাগবে। কেন জানি একটা অজনা ভয় কাজ করত মনে।
-তারপর
তারপর আর কি! হঠাৎ একদিন শুনলাম, তার বিয়ে হয়ে গেছে।
-তাহলে আর অযথা বসে বসে সময় নষ্ট করছেন কেন?
-স্বভাবিকভাবে চিন্তা করলে এটা এক ধরনের পাগলামিই বটে। কেন জানি আমার এখানে বসে থাকতে এখনও ভাল লাগে। হয়ত সে আর আসে না। দুই-তিন বার মাত্র এসেছে বিয়ের পর কিন্তু আগের মত গুন শুন করে পড়ে না, ভেজা চুল শোকানোর জন্য বারান্দায় এসে দাড়ায় না তবুও আমার সেই শূণ্য বারান্দাটায় সে আছে ভাবতেই ভাল লাগে। আসলে ভালবাসা একটা ভাবনা আর কি? সে ভাবে সে অন্যকারো, অথচ আমি ভাবি সে আমি আমার।
-সে কখনো জানতেই পারল না?
-জানবে কি করে? যদিও একই এলাকার ছিলাম, তার সাথে তো আমার কখনো কথাই হয়নি। অন্য কাউকে দিয়েও চিঠি দেওয়া নি। কলেজে যাওয়ার পথে কোন দিন রাস্তারোধ করে দাড়াইনি। নিজের ভেতরেই রয়ে সবটুকু ভালবাসা।
.
আর সব দিনের মত আমি চা খেয়ে চলে আসছিলাম কিন্তু আজ জোরাজুরি করেও বিল দিতে দিলনা। অনেকটা সামনে আসার পর হঠাৎ ডাক দিয়ে বলল,
"জমসেদ ভাই, রূপসাকে সুখে রাখবেন। ওকে সুখী দেখলেই আমি খুশি।"
পৃথিবীতে অনেক ধরনের মানুষ আছে, এরাও হয়ত এক ধরনের মানুষ যাদের কাউকে ভালবাসার জন্য সেই মানুষের উপস্থিতির দরকার হয়না।
আমি আর কোন উত্তর দিলাম না, পিছনেও ফিরে তাকালাম না। আস্তে করে মাথাটা ঝাকিয়ে হনহন করে হাটতে থাকলাম অন্ধকারে।
.
©® Asmaul Hossen Kawsar
বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৯
ভয়
সেদিন চন্দ্রা বলেছিল, "আমাদের মাঝে যে সম্পর্ক ছিল, এখন থেকে সব শেষ।"
সেদিনের সেই ঝগড়ার অনেকদিন পর আজ মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে তন্বয় ও চন্দ্রা। তন্বয় চিরায়ত সেই রূপে, গৌরবর্ণ তনু, এলোমেলো মাথা ভর্তি চুল, ছাই রঙের ফুলহাতা শার্টের হাতায় গুনে গুনে তিনটি ভাঁজ দিয়ে কুনুই পর্যন্ত উঠানো। কালো জিন্স। খুব পরিষ্কার না হলেও কালো বলে বুঝার নেই। উজ্জ্বল শ্যামা গাত্রবর্ণের তনু, পিঠ ছড়ানো খোলা চুল, সাদা আর আকশী নীলের নান্দনিক সমন্বয়ে সেলোয়ার-কামিজ, ছোট একটি টিপ যেটা কিনা উদাসী ভাবটাকে আরও গম্ভীর করে তুলে।
অথচ আজ চন্দ্রা বলছে, "কিছু অনুভূতি কখনো হারায় না, শেষ বলেলেই শেষ হয়ে যায়না। আমি শেষ বললাম আর তুমি মেনে নিলে? তোমার মাঝে কি আমাকে হারানোর কোন ভয় কাজ করে না? এত নির্লিপ্ত কিভাবে তুমি?
তন্বয় বলল, "আমাকে তুমি কখনো পুরোপুরি বুঝতে পারবেনা চন্দ্রা। আমরাই সম্ভব শেষ প্রজন্ম যারা রাতে মায়ের কাছে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম। বাড়ির বাইরে এদিক-ওদিক যেন না যাই সেজন্য বাইরের পৃথিবীতে সম্পর্কে একটা ভয়াল বর্ণনা দিত তারা। বাইরের জগতের রাক্ষস-খোক্ষস, ছেলেধরা আর দৈত্য-দানবের ভয় নিয়েই একটু একটু করে আমার বেড়ে ওঠা।
ওঠার সাথে সাথে আমার মনে যুক্তিবাদী ধারণা পাকা পোক্ক হতে থাকে। কোন এক সন্ধ্যায় পাশের বাড়ি দুটো করবস্থানের পাশ থেকে যেদিন একা একা বাড়ি ফিরতে পেরেছি সেদিনই অন্ধকারের ভয় জয় করেছি। তারপরও বড় হওয়ার সাথে সাথে নতুন নতুন কতগুলি ভয় জন্ম নিতে থাকে।
অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন। ভূত-প্রেতের ভয়টা তখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। একদিন পিঠাপিঠি কাজিন শাহাবউদ্দিন ভাই বলল, ঘরের পাশে একটা লাশ পড়ে আছে। বিশ্বাশ না করে আমরা কয়েকজন আবার গেলাম। একটু দূর থেকে দেখি, সত্যিই তো! আমরা দৌড়ে পড়ার ঘরে চলে এলাম। বুক তখনো দুপদুপ করে কাপছে। সাহস করে আবার গেলাম সবাই। হাটি হাটি পা করে দোয়া-দুরুদ পড়তে পড়তে একবারে কাছে গিয়ে হাত দিয়ে দেখি সাদা একপ্রস্থ পলিথিন ছাড়া কিছুই নয়। সে রাতের কাছ থেকে আমি যে কোন ভয়ের মুখোমুখি হওয়া সাহস ও শিক্ষা নিলাম।
জীবনের সবচে বড় পরীক্ষাটা আমাকে দিতে হয়েছে কলেজে পড়ার সময়। মিথ্যা একটা মামলায় বাবা তখন জেলে। দ্রুত মায়েরও শরীরিক অবনতি ঘটতে থাকল। অপরেশন থিয়েটার রুগীকে নেওয়ার আগে যে কোন কিছু ঘটতে পারে এমন ফর্মে সাক্ষর করার ফর্মালিটি সবাইকেই করতে হয়। কিন্তু মায়ের অবস্থা সেরকম ছিলনা, মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকেও আলাদা করে বলা হল অবস্তুা কতটুকু গুরুতর। যে কোন কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হল। তিল তিল করে জমানো পিতার বিশাল সম্রাজ্য থাকায় অর্থিকভাবে কোন সমস্যায় না পড়লেও পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় মানসিক দায়বদ্ধতাটুকু আমাকেই নিতে হয়েছে। বাবাকে কিছু জানিয়ে কোন লাভ নেই, টেনশন ছাড়া কিছু করার ক্ষমতা তার নেই। আমারও নেই। এ মুহুর্তে সারা পৃথিবী আর তার সম্পদ আমার কাছে মূল্যহীন। সেদিনের পর আর কখনো মনে হয়নি আমার হারানোর আর কিছু আছে। আমি সেদিন সব কিছু হারানোর ভয় জয় করেছি। ভেবেছিলাম আমার আর কিছু হারানোর নেই।
কিন্তু কিছু বাকী রয়ে গেছিল। তোমার আগেও কোন একজনকে ভেবেছিলাম যে আমাকে রঙিন দিনের স্বপ্ন দেখাত। আমাকে নিজের ভেতরে কাউকে নিয়ে ছোট একটা স্বপ্ন ছিল। সুন্দর একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন, নিজেকে ফিরে পাবার স্বপ্ন। কোন এক রক্তিম গোধূলিতে সেটিও হারিয়ে যায় নিকুশ কালো আধারে। তারপর নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয়টুকুও কেটে যায়। নিজের অস্তিত্বও শূণ্যতায় খাতায় নাম লেখিয়ে ফেলে।
পৃথিবীতে যাই ঘটুক না কেন, কোন কিছুতেই যেন আমার কিছু যায় আসে না। তোমাদের অনেক সাধের এ পৃথিবীকে অবাঞ্ছিত ঘোষনা করে অবঙ্গা করতে পারি আমি এতটা নির্লিপ্ত হতে পারি।"
চন্দ্রা একটা অস্পষ্টভাবে একটা শব্দ করল। তন্বয় বুঝতে পারে এটা হু হু কান্নার বহিঃপ্রকাশ। নিজের অনুভূতিগুলি লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করে চন্দ্রা। আজকাল নতুন একটা ভয়ের জন্ম নিয়েছে তন্বয়ের মনে। সামনে থাকা মানুষটি সে ভীষণভাবে চায়। আর এই বেশি চাওয়াটাই চন্দ্রাকে যেন দূর ঠেলে দিচ্ছে দিন দিন।
বৃহস্পতিবার, ২ মে, ২০১৯
কুদ্দুসদর্জি
জমিদার বাড়ির করা একটি তালিকায় সেরা দর্জির তালিকায় নিজেকে দ্বিতীয় অবস্থানে দেখে সবচেয়ে সুখী মনে করে কুদ্দুসদর্জি। নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই। চার ছেলে পাচ মেয়ে বৃদ্ধ বাবা-মা নিয়ে বিশাল সংসার তার। বড় ছেলের মেধা ভাল বলে জমিদার বাড়িতেই চাকুরী জুটিয়ে নিয়েছে। বিশাল জমিদার বাড়ির পরিধিও বিশাল। কানাঘুষা শোনা যায়, ঐ বাড়ির কোন এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়কে বিয়ে করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কাজের মেয়ের ভূমিকায় থাকলেও মেয়েটি জমিদার বাড়ির আত্মীয় বলে কথা। হেলায় তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। কুদ্দুসদর্জির বাকী তিন ছেলে এখনো বেকার। মেয়েগুলি নিজেরা স্বাবলম্বী হতে চাইলেও লোকে কি ভাববে এই চিন্তায় এখনো বের হতে দেয়া হয়নি। ছোট মেয়ের কথা আলাদা। ও একটু বেপরোয়া, কাউকে মানতে চায় না। কিছু না কিছু করে দেখাতে চায়।
কুদ্দুসদর্জি যে গ্রামে বাস করে সেখানে পাচ মোড়ল মিলে এলাকাটা শাষন করে। যদিও জমিদারী প্রথা এখন আর নেই তবুও সেই ডাক আর উপাধীটা লোকমুখে রয়ে গেছে। এর সাথে চৌধুরী, তালুকদার, মির্জা আর লষ্কর মিলেই সব সিন্ধান্ত নেয়। নিজেরা নিজের মাঝে মনোমালিন্য হলেও বৃহত্তর স্বার্থরক্ষায় তারা এক। খান বাড়ির লোকেরা প্রভাব প্রতিপত্তির লড়াইয়ে দুইবার উত্থান হলেও নানা নাটকীয়তার পর প্রতিবারই পাচ মোড়ল মিলেই শেষ পর্যন্ত তাদের শায়েন্তা করেছে। শেষ বার চৌধুরীরা তো খানদের পক্ষ নেয়া চন্ডালপাড়ার দুই বাড়ি এমনভাবে গুড়িয়ে দিয়েছে যে ভবিষ্যতে আর কেউ নিজের অপর্যাপ্ত শক্তি নিয়ে মাথা তুলে দাড়ানোরো চেষ্টা করবেনা। এই বৃহত্তর খেলায় কুদ্দুসদর্জি নেহাতই ক্ষুদ্র এক পিপীলিকাসম। এইসব নিয়ে তার ভাবলে হবে না। তার অনেক চিন্তুা। তিনবেলা পেটপুরে খাওয়ার চিন্তুা, অসুখে পড়লে কবিরাজের চিন্তুা, বাচ্চাদের পড়াশুনাও করাতে চায় আবার ভাল একটা ঘর বানাবার স্বপ্ন তো অনেক দিনের।
২
কুদ্দুসদর্জির অভাব পুরোটা যে তার নিজের দায় সেটা কিন্তু নয়। তাকে পাচ মোড়লকে খুশি রাখতে হয়। এই যেমন, একবার মির্জাসাহেব বলে দিলেন, "তোর তো অনেক শত্রু, নিরাপত্তার জন্য কিছু চাকু-বল্লম কিনা দরকার।" এ যুগে মোড়লবাড়িতে তখন বন্দুকগানের নতুন আবির্ভাব, চাকু-বল্লম অকেজো হয়ে পড়েছে। একথা তো আর মুখ ফুটে বলা যায় না। ওদের খুশি রাখায় বুদ্ধিমানের কাজ। না হলে দেখা যাবে এ ঘরে ইদুর আছে বলে সারা ঘরই খুড়ে নষ্ট করে ফেলবে। সেদিনটাও কথা আজও ভূলেনি কুদ্দুসদর্জি, তার কষ্টার্জিত উপার্জন দিয়ে চাকু-বল্লম কিনে তার ছেলেদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। সেদিন সাদাকালো টিবিতে সেদিন একটা খবর দেখেছিল কুদ্দুসদর্জি,
"রাশিয়া থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার অশ্র ক্রয়"
আট হাজার কোটি টাকা আসলে কত ঠিক অনুমান করতে পারে না কুদ্দুসদর্জি কিন্তু গর্বে তার বুকটা ভরে গেল। সত্যিই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।