মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৯

নোটবুক

নোটবুক ব্যাবহারের ইতিহাসটা অনেক আগের যখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়তাম, তখন থেকে। আজকালকার ভার্চুয়াল সামাজিক গণমাধ্যমগুলি তখনো এতটা বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি। সেই সব দিনগুলিতে মনের অনুভতিগুলি নোটবুকেই জমা থাকত। এখন যেমন শোবার ঘরের খবর পাবলিকের কাছে পৌছে যায় তখন ঠিক এর উল্টোটা ছিল। যেগুলো হয়ত বন্ধুদের কাছে বলার মত ছিল সেগুলিও নোটবুক দখল করে রাখত। কোনভাবে নোটবুক অন্যের হাতে পড়া মানে সাধারণত একটা বিব্রতকর অবস্থার জন্ম দিত। আমি যদিও কখনো সে দলের সদস্য ছিলাম না। বরং, এখনকার মত আমার সিক্রেটগুলিও হত ওপেন-সিক্রেট। এটা আমি করতাম যেন এতে অন্যদের আগ্রহ কম থাকে। সত্যি বলতে কি, ছোটবেলা থেকেই মানুষের সাইকোলজি বুঝতে চেষ্টা করতাম। দেখা গেল কয়েকদিন টেবিলে রাখা নোটবুক প্রথম কয়েকদিন নাড়া করে সমবয়সীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এরপর অনেককিছু লেখা এ নোটবুক সাবার সামনেই নির্লিপ্তভাবে পড়ে থাকত। আরও একটা বিষয় ছিল। আমি সরাসরি কিছু লেখাতাম না। নিজের সব গল্পগুলিই ছোটগল্প কিংবা কবিতায় মিশে থাকত। কবিতা বা গল্পের বিচারে যতই খারাপ হোক আমি তো জানি গল্পের পেছনের মানুষটি আমি, আমার সত্ত্বা কিংবা আমার সচেতন বা অবচেতন মনের কামনা-বাসনা-কল্পনা।
আমার নোটবুকে শুধু যে আমার নিজের লেখা থাকত তা কিন্তু নয়। প্রিয়-অপ্রিয় অনেকের লেখাও মাঝে মাঝে এসে গেছে। কেউ চুরি করে, কেউ জোর করে লিখেছে, আবার কাউকে অনুরোধ করেছি কিছু লেখার জন্য। এর মাঝে কতগুলি লেখার কোন হদিস একযুগেও পাইনি। একটি নোটবুকের চিরকুটে কে যেন লিখে দিয়ে গেছে,
"ভুল করে যদি কোন দিন, মনে পড়ে আমায়"
আমার প্রতি যাদের মোহ কিংবা আবেগ ছিল, যারা যারা লিখতে পারে সন্দেহ করা যায় তাদের প্রত্যেকে জেরা করা হয়েছে। কেউ স্বীকার করলনা।
আজ বার বছর পর আরেকটি নোটবুকে আরেকটি লেখা চোখে পড়ল যেখানে এক বালিকার নাম লেখা। তারপর লিখা, "দুজন দুজনকে ভালবাসি।" লেখাটি আমার নয়। কে লিখেছে জানিনা। তবে এটুকু জানি যে বালিকার নাম লেখা সে বালিকা এখন কারো ঘর সামলাতে ব্যাস্ত। বছরখানিক আগে তার সাথে শেষ বারের মত যখন দেখা হয়েছিল, স্বামী বাড়ি ছিলনা। তার কাছ থেকেই জানলাম, পরহেজগার স্বামী, খুব পর্দা মানেন, স্ত্রীর যত্ন নেন। "পুরাতন প্রেমিকের সাথে কথা বলছ শুনলে তো বেচারা হার্ট এ্যাটাক করবে" বলে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসেছিলাম। দূর এসে ফিরে দেখি বারান্দার একটি বাশের খুটি ধরে ভেজা চোখে সে কাঠমূর্তির মত ঠায় দাড়িয়ে আছে। আমি আর তাকালাম না। যে পিছনে পড়ে যায় তার দিকে ফিরে তাকানো আমার স্বভাবে পড়েনা।
নোটবুক খুললে এরকম গল্পে অসংখ্য চরিত্র সামনে এসে পড়ে। কারো গল্প এক পৃষ্ঠাতেই থমকে গেছে, কারো অস্থিত্ব কয়েকটি নোটবুক জুরে কিন্তু সবগুলি গল্পের সারমর্ম এক।
নোটবুকের এই গল্পগুলি পেছনে পড়ে গেছে। ভার্চুয়াল সামাজিক মাধ্যমের যুগে নোটবুক আজ কেবলই পিছনে পড়ে থাকা একটা ইতিহাস।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন