মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই, ২০১৯

তৃতীয় একজন

আমি যে চায়ের দোকানটিতে বসে আছি সেটা ছোট শহরের গলিতে থাকা আর দশটা চায়ের দোকানের মতই। মূল শহর থেকে খানিকটা দূরে শহরতলীতে নিম্ন মধ্যবিত্তদের আবাসিক এলাকায় কোনক্রমে দাড়িয়ে থাকা অর্ধস্থায়ী সে দোকানের অনিয়মিত এক কাস্টমার আমি।
এসব দোকানে অন্য এলাকার রিক্সাওয়ালা, নতুন বাড়ির সন্ধানে আসা বাড়াটিয়া, রাস্তা ভূলে বা বেড়াতে আসা কিছু আগুন্তক ছাড়া বাকী সবাই পরিচিত মূখ।
সকাল-বিকাল গার্লস স্কুল ছুটির সময় এলাকার যুবকদের প্রিয় হয়ে দোকানটি বাকীটা সময় নিষ্কর্মা গুটি কয়েক বৃদ্ধদের দখলেই থাকে। তাদের আড্ডা সুবোধ চ্যাটার্জির অবাধ্য বউ থেকে শুরু হয়ে ক্রিকেটের মাঠে মুস্তাফিজুরের আউটসুইং হয়ে আমেরিকার বুশ পর্যন্ত ঠেকে।
.
এইসব সাধারণ চরিত্রের বাইরেও আরও একজন থাকে এই দোকানে। বয়সের দিক থেকে যুবক হলেও গার্লসস্কুলের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। একটি বই হাতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে। ইতিহাস, বিঞ্জান আর শিল্পেকলার বাহারী বই দেখে বোঝার উপায় সে আসলে কি নিয়ে পড়াশোনা করে বা আদৌ কোন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে কি না। তবে পড়া যে তার খুব প্রিয় এ নিয়ে সন্দেহ করার আবকাশ নেই। দোকানদারের খুবই প্রিয় পাত্র। তার কাছে দোকানে দায়িত্ব দিয়ে দুপুরের স্নান আহার কিংবা দুপুরে বাজারের দিকে একবার চক্কর দিয়ে আসা যায় সহজেই।
.
হ্যালির ধূমকেতুর মত আমি নেহাত শশুরবাড়ি আসলে আমিও ক্ষণিকের জন্য দোকানের অংশ হয়ে যাই। ঘরে বানানো চা থেকে ছোটখাট এসব দোকানের চা-ই আমাকে বেশি টানে।
.
চুপিসারে বিয়ের কাজ শেষ করার পর দুই বছরে এখানে আমার তিন বার আসা। আমি ছোট হাসি দিয়ে "কেমন আছেন" বলে হাত বাড়িয়ে দিলাম।
-"এই তো ভাল, আপনি?" বলে সেও হাত বাড়িয়ে দিল। খানিকটা অস্বস্তিবোধও করছে। বুঝলাম, কোন এক কারণে সে আসলে আমাকে খুব ভাল করে চিনে কিংবা লোকটির স্মৃতি শক্তি ততটা ভাল নয় হয়ত নতুবা কে জানে, হয়ত খেয়াল করে আমাকে দেখেনিও কোন দিন।
.
ব্যাপারটা আমার কাছেও অস্বস্তিকর। খোলাসা করে বলে দিলাম, "আমিও আগেও দু এবার এখানে চা খেতে এসেছি। প্রত্যেকবারই আপনাকে দোকানে দেখেছি। চা কি আপনার খুবই প্রিয়?"
সে বলল, "চা এতটা প্রিয় না হলেও, দোকানটি প্রিয়।"
আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। চা প্রিয় নয় কিন্তু দোকানটি প্রিয়। আমি বেশ কৌতূহল বোধ করলাম, "মানে?"
-"না আসলে ঐ যে ঈশান কোনে যে বাড়িটি দেখছেন সেটির দুইতালার বেলকুনি আর তার পাশের জানালাটি আমার প্রিয়। এজন্যই এখানে বসা।"
এ তো আমার শশুর বাড়ির বাসা। এসব কিছু বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করলাম,
-কেন?
- কখন কিভাবে জানিনা, হঠাৎই নিজের ভিতর হৃদস্পন্দনে একজনকে অনুভব করতে শুরু করেছিলাম। সকালে গুন গুন করে সে পড়তে বসে আমি দূর থেকে যেন সঙ্গীতের রাগ-রাগীনি  খুজে পাই। দুপুরে তার সিক্ত চুলে আমি স্নিগ্ধতা লাভ করি। রাতে নিয়ন আলোয় তার ছায়ায় আমি দূর্নিবার এক মায়া উপলদ্ধি করতে থাকি।"
-তারপর
- বেশি ভালবাসা একটা পর্যায়ে বাস্তব যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। এতটাই বেশি যে, সে মানুষটির সামনে দাড়াতেই ভয় হয়। আমি কখনো তার কাছ থেকে না শুনতে চাইনি। তার মুখ থেকে না শুনার পর পৃথিবীতে নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে হবে। হয়ত বেচে থাকাটাই বিস্বাধ লাগবে। কেন জানি একটা অজনা ভয় কাজ করত মনে।
-তারপর
তারপর আর কি! হঠাৎ একদিন শুনলাম, তার বিয়ে হয়ে গেছে।
-তাহলে আর অযথা বসে বসে সময় নষ্ট করছেন কেন?
-স্বভাবিকভাবে চিন্তা করলে এটা এক ধরনের পাগলামিই বটে। কেন জানি আমার এখানে বসে থাকতে এখনও ভাল লাগে। হয়ত সে আর আসে না। দুই-তিন বার মাত্র এসেছে বিয়ের পর কিন্তু আগের মত গুন শুন করে পড়ে না, ভেজা চুল শোকানোর জন্য বারান্দায় এসে দাড়ায় না তবুও আমার সেই শূণ্য বারান্দাটায় সে আছে ভাবতেই ভাল লাগে। আসলে ভালবাসা একটা ভাবনা আর কি? সে ভাবে সে অন্যকারো, অথচ আমি ভাবি সে আমি আমার।
-সে কখনো জানতেই পারল না?
-জানবে কি করে? যদিও একই এলাকার ছিলাম, তার সাথে তো আমার কখনো কথাই হয়নি। অন্য কাউকে দিয়েও চিঠি দেওয়া নি। কলেজে যাওয়ার পথে কোন দিন রাস্তারোধ করে দাড়াইনি। নিজের ভেতরেই রয়ে সবটুকু ভালবাসা।
.
আর সব দিনের মত আমি চা খেয়ে চলে আসছিলাম কিন্তু আজ জোরাজুরি করেও বিল দিতে দিলনা। অনেকটা সামনে আসার পর হঠাৎ ডাক দিয়ে বলল,
"জমসেদ ভাই, রূপসাকে সুখে রাখবেন। ওকে সুখী দেখলেই আমি খুশি।"
পৃথিবীতে অনেক ধরনের মানুষ আছে, এরাও হয়ত এক ধরনের মানুষ যাদের কাউকে ভালবাসার জন্য সেই মানুষের উপস্থিতির দরকার হয়না।
আমি আর কোন উত্তর দিলাম না, পিছনেও ফিরে তাকালাম না। আস্তে করে মাথাটা ঝাকিয়ে হনহন করে হাটতে থাকলাম অন্ধকারে।
.
©® Asmaul Hossen Kawsar

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন