সেদিন চন্দ্রা বলেছিল, "আমাদের মাঝে যে সম্পর্ক ছিল, এখন থেকে সব শেষ।"
সেদিনের সেই ঝগড়ার অনেকদিন পর আজ মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে তন্বয় ও চন্দ্রা। তন্বয় চিরায়ত সেই রূপে, গৌরবর্ণ তনু, এলোমেলো মাথা ভর্তি চুল, ছাই রঙের ফুলহাতা শার্টের হাতায় গুনে গুনে তিনটি ভাঁজ দিয়ে কুনুই পর্যন্ত উঠানো। কালো জিন্স। খুব পরিষ্কার না হলেও কালো বলে বুঝার নেই। উজ্জ্বল শ্যামা গাত্রবর্ণের তনু, পিঠ ছড়ানো খোলা চুল, সাদা আর আকশী নীলের নান্দনিক সমন্বয়ে সেলোয়ার-কামিজ, ছোট একটি টিপ যেটা কিনা উদাসী ভাবটাকে আরও গম্ভীর করে তুলে।
অথচ আজ চন্দ্রা বলছে, "কিছু অনুভূতি কখনো হারায় না, শেষ বলেলেই শেষ হয়ে যায়না। আমি শেষ বললাম আর তুমি মেনে নিলে? তোমার মাঝে কি আমাকে হারানোর কোন ভয় কাজ করে না? এত নির্লিপ্ত কিভাবে তুমি?
তন্বয় বলল, "আমাকে তুমি কখনো পুরোপুরি বুঝতে পারবেনা চন্দ্রা। আমরাই সম্ভব শেষ প্রজন্ম যারা রাতে মায়ের কাছে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম। বাড়ির বাইরে এদিক-ওদিক যেন না যাই সেজন্য বাইরের পৃথিবীতে সম্পর্কে একটা ভয়াল বর্ণনা দিত তারা। বাইরের জগতের রাক্ষস-খোক্ষস, ছেলেধরা আর দৈত্য-দানবের ভয় নিয়েই একটু একটু করে আমার বেড়ে ওঠা।
ওঠার সাথে সাথে আমার মনে যুক্তিবাদী ধারণা পাকা পোক্ক হতে থাকে। কোন এক সন্ধ্যায় পাশের বাড়ি দুটো করবস্থানের পাশ থেকে যেদিন একা একা বাড়ি ফিরতে পেরেছি সেদিনই অন্ধকারের ভয় জয় করেছি। তারপরও বড় হওয়ার সাথে সাথে নতুন নতুন কতগুলি ভয় জন্ম নিতে থাকে।
অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন। ভূত-প্রেতের ভয়টা তখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। একদিন পিঠাপিঠি কাজিন শাহাবউদ্দিন ভাই বলল, ঘরের পাশে একটা লাশ পড়ে আছে। বিশ্বাশ না করে আমরা কয়েকজন আবার গেলাম। একটু দূর থেকে দেখি, সত্যিই তো! আমরা দৌড়ে পড়ার ঘরে চলে এলাম। বুক তখনো দুপদুপ করে কাপছে। সাহস করে আবার গেলাম সবাই। হাটি হাটি পা করে দোয়া-দুরুদ পড়তে পড়তে একবারে কাছে গিয়ে হাত দিয়ে দেখি সাদা একপ্রস্থ পলিথিন ছাড়া কিছুই নয়। সে রাতের কাছ থেকে আমি যে কোন ভয়ের মুখোমুখি হওয়া সাহস ও শিক্ষা নিলাম।
জীবনের সবচে বড় পরীক্ষাটা আমাকে দিতে হয়েছে কলেজে পড়ার সময়। মিথ্যা একটা মামলায় বাবা তখন জেলে। দ্রুত মায়েরও শরীরিক অবনতি ঘটতে থাকল। অপরেশন থিয়েটার রুগীকে নেওয়ার আগে যে কোন কিছু ঘটতে পারে এমন ফর্মে সাক্ষর করার ফর্মালিটি সবাইকেই করতে হয়। কিন্তু মায়ের অবস্থা সেরকম ছিলনা, মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকেও আলাদা করে বলা হল অবস্তুা কতটুকু গুরুতর। যে কোন কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হল। তিল তিল করে জমানো পিতার বিশাল সম্রাজ্য থাকায় অর্থিকভাবে কোন সমস্যায় না পড়লেও পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় মানসিক দায়বদ্ধতাটুকু আমাকেই নিতে হয়েছে। বাবাকে কিছু জানিয়ে কোন লাভ নেই, টেনশন ছাড়া কিছু করার ক্ষমতা তার নেই। আমারও নেই। এ মুহুর্তে সারা পৃথিবী আর তার সম্পদ আমার কাছে মূল্যহীন। সেদিনের পর আর কখনো মনে হয়নি আমার হারানোর আর কিছু আছে। আমি সেদিন সব কিছু হারানোর ভয় জয় করেছি। ভেবেছিলাম আমার আর কিছু হারানোর নেই।
কিন্তু কিছু বাকী রয়ে গেছিল। তোমার আগেও কোন একজনকে ভেবেছিলাম যে আমাকে রঙিন দিনের স্বপ্ন দেখাত। আমাকে নিজের ভেতরে কাউকে নিয়ে ছোট একটা স্বপ্ন ছিল। সুন্দর একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন, নিজেকে ফিরে পাবার স্বপ্ন। কোন এক রক্তিম গোধূলিতে সেটিও হারিয়ে যায় নিকুশ কালো আধারে। তারপর নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয়টুকুও কেটে যায়। নিজের অস্তিত্বও শূণ্যতায় খাতায় নাম লেখিয়ে ফেলে।
পৃথিবীতে যাই ঘটুক না কেন, কোন কিছুতেই যেন আমার কিছু যায় আসে না। তোমাদের অনেক সাধের এ পৃথিবীকে অবাঞ্ছিত ঘোষনা করে অবঙ্গা করতে পারি আমি এতটা নির্লিপ্ত হতে পারি।"
চন্দ্রা একটা অস্পষ্টভাবে একটা শব্দ করল। তন্বয় বুঝতে পারে এটা হু হু কান্নার বহিঃপ্রকাশ। নিজের অনুভূতিগুলি লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করে চন্দ্রা। আজকাল নতুন একটা ভয়ের জন্ম নিয়েছে তন্বয়ের মনে। সামনে থাকা মানুষটি সে ভীষণভাবে চায়। আর এই বেশি চাওয়াটাই চন্দ্রাকে যেন দূর ঠেলে দিচ্ছে দিন দিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন