মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২০

অভিমানের দেয়াল

সে কি বৃষ্টিস্নাত কৃষ্ণপক্ষের নিশিতেও বাইরে দৃষ্টি রাখছে?
চিরচেনা কেউ ভিজে চুপসে সামনে এসে দাড়াবে বলে।
না কি আপেক্ষা রয়েছে সেই ছপছপ শব্দের?
যে শব্দের সাথে মিশে আছে তার ছন্দহীন গতির অসম তাল।
সে কি সুক্ষ্ম কোন একটা তীঘ্ন ঘ্রাণের সন্ধান আছে,
যেখানে মিশে আছে দূর থেকে আসা প্রিয় কারো ঘামের নোনা গন্ধ।
নাকি অভিমানের দেয়াল তুলে,
কপাট করেছে আজ বন্ধ?

তোমি, আমি ও একটি দ্বিপ

শেষবার তোমাকে নিয়ে একটি দ্বিপে গিয়েছিলাম। সময়গুলি কত সুন্দরই না ছিল। কিন্তু শেষ রাতের কালবৈশাখী ঝড় এলোমেলো করে দেয় সবকিছু। সকালে দেখি অতল জলে ডুবে গেছে তোমার পদচিহ্ন। তোমাদের সাথে অভিমান করে আমিও চলে যাই আরও দূরে।

মাস দেড়েক পর ফিরে এসে দেখি তোমার সাথে এখনো দ্বিপটি এখনো অভিমানের গভীর জলে ডুবে আছে। না, আমি কোন ঐতিহাসিক চরিত্র 'শিরি'র ফরহাদ নই যে মহা-দরিয়া সেচে আমার শিরিকে উদ্দার করতে পারিনা। কিন্তু প্রতিক্ষার প্রহর নিয়ে সেই সময়টার অপেক্ষা তো করতেই পারি, যে সময়টা শুধুই আমাদের।

দুই মাস ছয় দিনের মাথায় আমার প্রতিক্ষা ফুরাল। জলরাশির বুক চিরে সেই দ্বিপটি আবার জেগে উঠেছে।

কাশবনে ছেয়ে আছে সবুজের বাসর।
হয়তো অভিমানের পাহাড় ভেঙ্গে অদূর ভবিষ্যতেই সে দ্বিপের বুকে হেটে যাবে দুই জোড়া পা। শুধু এইবারই নয়, যতবার দ্বিপটি হারিয়ে গিয়ে জেগে উঠবে ততবার। আর বারংবার একে দেবে দুইজোড়া পদচিহ্ন।

কাগজের প্রেম

প্রথাগত বাস্তব জীবনের বাইরেও কতগুলি নারী চরিত্রের প্রেমে আমি পড়েছি। এদের দেখা মিলে বইয়ের পাতায়, অক্ষরে অক্ষরে পাতার পরতে পরতে সাজানো থাকে তাদের অবয়ব। মনের একটা অংশ জুরে থাকা এই চরিত্রগুলো শুধু আক্ষেপই বাড়িয়ে দিতে পারে।

প্রিয়াংকাঃ আমার প্রথম প্রেম প্রিয়াংকা। জাফর ইকবাল স্যারের "আমি তপু" বইটা পড়ার পর প্রিয়াংকার মত এমন একজনকে পেতে বারবার নিজেকে কঠিণ সময়ে থাকা তপুর জায়গায় ভাবতে ইচ্ছে করে। স্রোতের বিপরীতে চলা প্রিয়াংকা আমার কিশোর মনকে নাড়িয়ে দিয়েছিল ভীষণভাবে। আজও কারো সাথে পরিচিত হওয়ার সময় প্রিয়াংকা নাম বলে হৃদয়ের বিট একটু হলেও নড়ে ওঠে।

রূপাঃ হুমায়ূন আহমেদ রুপার প্রেমে আমি ছাড়াও যে কতজন পড়েছে তার হিসাব নাই করা হল। মাঝে মাঝে হিমু হওয়ার স্বাদ জাগে কিন্তু নীল শাড়ী পড়ে রূপা অপেক্ষা করে আছে ভাবতেই ইচ্ছে হয় সব কিছু ছেড়ে দিয়ে রুপার কাছে গিয়ে বলি, "তোমার প্রতীক্ষা শেষ রুপা, চল তোমার অশ্রু দীঘিতে স্নান করে আমি হিমু হওয়ার সাধনা ত্যাগ করব। বাকীটা জীবন দুজনে একসাথেই হাটব।" যদিও আমি নিশ্চত বদলে যাওয়া হিমুকে রুপা আর সহ্য করতে পারবে না।

রাকাঃ সুনীলদার রাকা বইটা যতবার পড়ি, রাকার জীবনে নিজেকে আবিষ্কার করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বইটি এমনভাবে লেখা যে নিজেকে কোথাও জায়গা দিতে পারিনা। বেশ কজন পুরুষ রাকাকে ছুয়ে যায় কিন্তু কেউ স্থায়ী হতে পারেনা। আমিও পারবনা। আমার কাছে রাকা একটা ঘোরের মত। নেশা ধরিয়ে দিয়। মোহ বা নেশা কেটে গেলে, সেও কেটে যাবে।

মার্গেরিটঃ এটা সুনীলদার জীবনীতে পাওয়া বাস্তব একটা চরিত্র হলেও আমার কাছে মায়ার মত। মার্গেরিটের প্রেমে পড়ে আমি যেন সকল ফরাসী মেয়েরই প্রেমে পড়ে গেছি। মার্গেরিটের ঠিকানা আমি হাইলাইট করে রেখেছি। স্টাচু অব লিবার্টি কিংবা আইফেল টাওয়ার নয়, যদি কখনো আমেরিকা যাবার সুযোগ হয় তবে মার্গেরিট অ্যাওয়ারা নামের যে শহরটিতে কাজ করত সে শহর আর তার ফরাসীতে থাকা তার বাড়ি অবশ্যই দেখে আসব।

নদী

সুরমা নদীটি আমার পিঠাপিঠি ছোট বোনের মত। খুব মায়ার, বেশির ভাগ সময়ই পাশাপাশি থাকি তবু খুব একটা পাত্তা দেই না। কুশিয়ারা অনেকটা দূর সম্পর্কের বোনের মত। বাইরে থেকে বুঝা যায় না কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটু ভাব আছে।
ব্রহ্মপুত্র যেন আমার আদি সত্ত্বা, নিজের পূর্বপুরুষ। মাঝে মাঝে মনে হয় হাজার বছরের অবর্তনে ব্রহ্মপুত্রের উত্তরপুরুষ হয়ে আমি এই ভূখন্ডে এসেছি। মেঘনার সাথে মায়ের একটা সাদৃশ্য আছে। সব সন্তান যেমন মেয়ের কোল খোজে তেমনই বেশির ভাগ নদীকেই আকড়ে ধরে রেখেছে মেঘনা।
আমার একটা প্রেয়সী নদী আছে যাকে দেখলেই মনে হয় যুগ যুগ ধরে নদীটি আমার জন্য অপেক্ষা নিরবে বয়ে চলেছে। রূপসার কি রূপে আমি বিমোহিত হয়েছি জানিনা কিন্তু প্রথম যেদিন নদীটির সামনে গিয়ে দাড়ালাম, মনে হল সে যেন আমাকে বলছে, "এতদিন পর তোমার আসার সময় হল বুঝি?"

কৃষ্ণরাতের শেফালী

কোন এক চতুর্দশীর রাতে
সে ভিজেছিল বৃষ্টিতে।
জলোচ্ছ্বাসে ভেঙ্গে গিয়েছিল সংকোচের বাধ,
প্রতীক্ষা এখন তার সাদা কেশের মত
বিবর্ণ দেয়াল পেরিয়ে
শুভ্র চাদর গায়ে মেখে
ওপারে গিয়েও পেতে চায় সে স্বাধ।
কৃষ্ণপক্ষ কেটে আসে পূর্ণিমা
আষাড়ের মেঘ মিশে শরতের ঘাসে
সেই সাথে নড়ে ওঠে আরেকখানি দাত
কৃষ্ণরাতের শেফালী চায় পূর্ণিমার স্বাধ।

সম্রাট

একজন সম্রাটকে কিভাবে আপনি ব্যাখ্যা করবেন?
একজন সম্রাট প্রথমে একজন সম্রাট। তারপর হয়তো সে কারো সন্তান, পিতা কিংবা একজন ধার্মিক। সে কারো পিতা, কারো সন্তান কিংবা কোন ধর্মের এই দিয়ে কোন সম্রাটের ব্যাখ্যা হয়না।
একজন সম্রাট প্রথমেই ধার্মিক হয়না। অশোক দ্যা গ্রেট যিনি যুদ্ধ বিবাদ এড়িয়ে রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে অহিংস বুদ্ধি ধর্মের আশ্রয় নেন। খ্রিস্ট ধর্ম ছড়িয়ে যাবার পর জনগন গ্রাস থেকে রাজ্য উদ্ধার করতে বহু ইহুদী রাজা খ্রিষ্টান ধর্মকে পেট্রোনাইজ করেছে।
আমরা বিপদে ভ্রাতাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াই অথচ, একজন সম্রাটের প্রধান শত্রু তারই পিতার মাতার ঔরসজাত সন্তান। আওরঙ্গজেবের রাজ মসনদে বসা নিয়ে প্রচলিত একটা কাহিনী আছে। তৎকালীন অন্যতম বুদ্ধিজীবী সারমাদ শহীদকে রাজা জিজ্ঞেস করল, পাশে কম্বল থাকতেও সে নগ্ন কেন? জবাবে রগচটা সারমাদ বলল, খারাপ লাগলে মহারাজাই যেন নগ্নতা ঢেকে দেয়। রাজা পাশে থাকা কম্বলটি টান দিতেই বেরিয়ে এল অনেকগুলি কাটা মাথা যা কি না তারই ভ্রাতা কিংবা উত্তরসূরীদের। সারমাদ এরপর বলল,
"কম্বল দিয়ে কি ঢাকবেন মহারাজা, আমার শরীর না আপনার কলঙ্ক?"
বলা হয়ে থাকে সন্তানের প্রতি পিতার ভালবাসার কোন তুলনা হতে পারে না। অথচ, রাজমুকুট মাথায় দিয়ে সিংহাসনে বসা মানুষটির বেলায় সেটি সত্য নাও হতে পারে। উসমানীয় সম্রাজ্যের দশম সুলতান সুলেইমানের যিনি "সুলায়মান দ্য ম্যাগ্নিফিসেন্ট" নামে খ্যাতি লাভ করেছেন এবং উসমানীয় শাশকদের মধ্যে সবচে' দীর্ঘকাল ব্যাপী মহারাজের দায়িত্ব পালন করেন। তারই ছেলে মোস্তফা জনপ্রিয় হয়ে যখন রাজার জন্য হুমকি হয়ে দাড়ালেন তখনই পিতা রাজার রূপ ধারন করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দান করলেন।
তবে মুঘল সম্রাট হুমায়ূন, উসমানীয় সম্রাট দ্বিতীয় সেলিম কিংবা খুনি চেঙ্গিসের উত্তরাধিকারী ওগেদাই খানদের ব্যাতিক্রমী স্বভাব কিছুটা হলেও ভিন্নমাত্রা দেবে।
আবার অন্যভাবে চিন্তা করলে, এই পৃথিবীতে সম্রাটের মত নিঃসঙ্গ আর কেউ হতে পারেনা। তার কোন ভাই, বন্ধু কিংবা সন্তান হয়না। বোকা রাজাটা কি উপলদ্ধি করতে পারেনা যে, ঘরে কিংবা শত্রু শিবিরের কেউ নয় নিজেকে সর্বক্ষমতাময় প্রমান করতে যে মুকুটখানি পড়েছিল, এটাই প্রধান শত্রু।
অথচ, কোমরবদ্ধে থাকা অন্ধ খুনি খঞ্জরটাই তার সবচে বিশ্বস্ত বন্ধু।
দিন শেষ এটাই সত্যি যে, একজন সম্রাট প্রথমে একজন সম্রাট।

সঙ্গী

আমার একজন সঙ্গী চাই।
কিন্তু কখনোই চাইনা যে গলায় কাঁটার মত আটকে থাকুক
আমার দেয়া মঙ্গলসূত্রখানি।
এও চাইনা কাউকে সাতপাকে বেঁধে
আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিতে।

আমার একজন সঙ্গী চাই।
কোন কারণ ছাড়াই যে আমার পাশে থাকবে
কোন বন্ধন ছাড়াই যে আমাকে ভালবাসবে
আমার একজন সঙ্গী চাই
যে কোন কারণ ছাড়াই চলে যেতে পারবে।