মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট, ২০২০

পাঁচ নম্বর প্লাটফর্ম

পার্বতীপুর জংশন।
কেন কিভাবে এই স্টেশনে আসলাম সেটিও আরেকটি গল্প, আজ সে গল্প নাই বলি। উত্তর বঙ্গের সবচেয়ে বড় এই স্টেশন নিয়ে আজকের আগে কোনদিন তো ভাবিইনি আমার ঞ্জানের স্বল্পতায় হোক বা অন্য কোন কারণে হোক কোনদিন নামও শুনিনি এই স্টেশনের। স্টেশনটি আমার পছন্দ হয়ে গেল নাম শুনেই। পার্বতীপুর! কি সুন্দর একটা নাম। ভাল লাগার জন্য আর কোন কিছুর দরকার পড়েনি। স্টেশন তিনটি মূল অবকাঠামো দিয়ে মোট পাঁচটি প্লাটফর্ম।

এক নম্বর প্লাটফরম থেকে পঞ্চগড় থেকে থেকে ছেড়ে আসা দ্রুতযান ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। ছুটি কাটিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে ঢাকায় যাওয়া মানুষের দলটাই বেশি ভারী। আমরাও সেই দলের মানুষ তবে আমাদের উদ্দেশ্য ঢাকা হয়ে সিলেট। বাড়ি ফেরা।

ট্রেনে আসতে এখনো দেরী আছে। বাইরে স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে একটা ভাত খাবার মত একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম। উত্তর বঙ্গে খাবারের দাম অনেক কম। কতটা কম তার একটা ব্যাখ্যা দেই। আমরা দুই বন্ধু মিলে ভাত, সবজি, ডাল, মাংস (৮ পিস) এবং সবশেষে চা খেয়ে বিল দিতে গিয়ে দেখি মাত্র একশ টাকাও খরচ করতে পারেনি দুজন। পঁচানব্বই টাকা দুজনের বিল সেটাও ২০১৯ সালে!

তারপর আবার ফিরে এলাম স্টেশনে।
শেষ প্লাটফর্মটি তুলনামূলক খালি। আমাদের ট্রেন আসবে রাত বারটার দিকে। তখন মাত্র নয়টা বাজে। আমরা ভিড় এড়িয়ে অব্যাহত খালি পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মটিতে বিশ্রাম নিতে চলে এলাম। কলামে ব্যাগ রেখে গা এলিয়ে দিলাম। ক্লান্তিতে চোখ লেগে আসছে আমাদের। মোবাইলে এলার্ম দেওয়া ছিল সাড়ে এগারোটায়। ট্রেন মিস করারও সম্ভবনা নেই।

ঘুমাতে পারলে হয়ত ভাল হত। পাশেই এক মহিলাকে শুনছি, অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছে এক পুরুষের সাথে। মহিলার বয়স খুব বেশি না হলেও স্টেশনে ময়লা আবর্জনায় পড়ে থাকার ফলে আন্দাজ করা গেল না। তবে পুরুষ লোকটির বয়স পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মাঝামাঝি হবে। ঝগড়ার বিষয়বস্তু বুঝতেও বেশি সময় লাগল না।
- তুই বাড়িত গিয়া তর মা বইনের লগে কর। পঞ্চাশ টাকায় কাম করতে আসছে, এ ট্যাহা দিয়া কনডমই কিনন যায় না। যা এহান থাইক্যা।
বলেই গালাগালি শুরু করল। 
(কা)পুরুষ লোকটি মিনমিন করে বলল, পঞ্চাশে যাইবি?
মহিলা আবার সেই পুরুষ লোকটির চৌদ্দগুষ্ঠি নিয়ে গালিগালাজ করতে শুরু করল।
এমতাবস্থায় এখানে আর থাকা গেল না।

আমি আর মাহদী এই প্লাটফর্মেরই বিপরীত প্রান্তে গিয়ে বসলাম। সেখানে এক ভদ্রগোছের লোক বসা। বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। ট্রেনে কোন সিট না থাকায় তখনও আমার চিন্তা করছিলাম আমরা ফিরে যাব কি না। টানা তিনদিন আমরা ভ্রমণের মাঝেই আছি আর সারারাত ট্রেনের ছাঁদে বসে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতাও আমাদের নেই। দুই-একবার শখে চড়েছি এই যা।

দেখতে ভদ্রলোক, মনেহয় মোটামুটি শিক্ষিত, ব্যাবহারে মার্জিত লোকটির সাথে আমরা গল্পজুরে বেশ দ্রুতই। নতুন কারো সাথে দ্রুত মিশে যাওয়ার ব্যাপারে মাহদীর দক্ষতা ভাল। আমাদের ভ্রমণের উদ্দেশ্য, টিকিটের হাহাকার, শরীরজুরে অবসাদ সব খুলে বলা হল ভদ্রলোকে। তারপর তার কাছে পরামর্শ চাইলাম। তিনি একরাত থেকে যাওয়ার পক্ষে মত দিলেন। আমারও ইচ্ছে তাই। আর মাহদী ইচ্ছে যত দ্রুত সিলেট বা ঢাকা ফিরা যায়। তারপর বিশ্রাম।

প্রেক্ষাপটে দাত কেলাতে কেলাতে এক তরুণের আবির্ভাব। কথাবার্তায় যতটুকু বুঝতে পারছিলাম ভদ্রলোকের পূর্ব পরিচিত। ভদ্রলোকের সাথে তার সম্পর্ক কি সেটা বুঝতে পারছিলাম না। জেনে অবাক হলাম, তিনি কোথাও যাবেন না। এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা, পাশেই তার বাড়ি।

তরুণ ছেলেটির বয়স সতের আঠারোর মত হবে। বলল, মামা খেইলা আইলাম। পুরা এক ঘন্টা খেলেছি।
এই তরুণ যে কোন কৃষ্ণলীলা করে এসেছে সেটা বুঝতে আর বাকি থাকে না। আমরা না শুনার ভান করে ভদ্রলোকের সাথে কথা বলায় মনযোগ দেই। আর আমরা কান না দিলেও তরুণটি তার বর্ণনা দিতে থাকল।

৩.
আসলে, প্রথমের ঐ মিনমিনে পুরুষ পরের ভদ্রলোক কিংবা তরুণ এরা একই পেশার ভিন্ন শ্রেণীর দালাল। এদের মূল উদ্দেশ্য নিজে খেলা না, খেলোয়াড় খুঁজে বের করা।

মাহদী তাদের উদ্দেশ্য ধরতে না পেরে ভদ্রলোকের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকলেও আমি পরিস্থিতি অনুধাবন করে তাকে চা খাওয়ার অজুহাত ধরে বের করে নিয়ে এলাম।
পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মের আর ফিরে গেলাম না।


আসমাউল হোসেন কাওসার।
ঘটনাকালঃ আগস্ট ২০১৯
লেখাঃ আগস্ট ১৮, ২০২০

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন