ভোর পাচটায় ঘুম থেকে উঠার কথা থাকলেও আড়মোড়া ভেঙে উঠতে উঠতে বিশ মিনিট দেরি করে ফেললাম। সজীবদাকে ফোন দিলাম সাথে সাথেই। উনি ইতিমধ্য রাবিব ভাইয়ের ফোনে জেগে উঠেছেন। উনার একাউন্টে ব্যালেন্স না থাকায় হাসানকে ফোন দেয়ার দায়িত্ব আমার উপর বর্তাল। হাসানকে বলেছিলাম ও যেন সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয় অথচ আমারই ফোন দিতে হল।
যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটা না। ইতিমধ্য হাসানের ঘুম ভেঙেছে। বললাম তারাতাড়ি রেডি হতে। আমার ব্যাগ রাতেই ঘুছানো ছিল। ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে পড়লাম পাচটা চল্লিশের দিকে। মদিনা মার্কেটে সজীবদা'র সাথে দেখা। রাহাত ভাই ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে সিলেট এসে পৌছে গেছে। সাবার অবস্থানই ভাল শুধু হৃদয়ই লা-পাত্তা। কোন খবর নেই। ফোনও বন্ধ অথচ সেই অন্যতম প্রধান উদ্যোগতা। আমি আর সজীবদা ভাবলাম হাসানকে ওর বাসা থেকে পিক করে নেব কিন্তু ওর বাসার সামনে আসার পর ও আরও পাচ মিনিটের মত লাগবে। হাসানের পাচ মিনিট হতে যে কত সেকেন্ড লাগে সেটা বিধাতার মর্জিমাফিক।
আমার ওর আশা ছেড়ে দিয়ে স্টেশনের দিকে ছুটলাম। সেখানে গিয়ে রাবিব ভাইয়ের সাথে একত্রিত হয়ে জানতে পারলাম রাতে হৃদয়ের কথা হয়েছে যে তারা সকালে একসাথে হাটতে হাটতে স্টেশনে চলে আসবে। কিন্তু সকাল থেকে আর কোন খবর নেই ছেলেটার। হাসান আর হৃদয় কি শেষ পর্যন্ত ট্রেন ধরতে পারবে?
আমি বারবার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিলাম। রাবিব বলল, আজকাল কেউ এভাবে রাস্তার দিকে তাকায় না, সবাই ফোন করেই লোকেশন জেনে নেয়। চা খেতে খেতে রাহাত ভাই যোগ দিলে আমাদের দলে। সারারাত জার্নি করে হাম হামের মত জায়গায় (আসলে অজায়গায়) যেতে হলে যতেষ্ঠ সাহসিকতার দরকার আছে।
২.
ট্রেন ছুটতে শুরু করল স্টেশন ছেড়ে। শেষ পর্যন্ত হাসান যোগ দিতে পারল আমাদের সাথে। কিন্তু হৃদয় মিসিং তখন পর্যন্ত। আমরা অনেকটাই হতাস। ট্রেন ছড়ার আগ মুহুর্তে পর্যন্ত ভাবছিলাম যে কোন মুহুর্তে হয়ত এসে যাবে সে। মানুষ হয়ে জন্মেছি বলেই হয়তো শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আশা ধরে রেখেছিলাম। যেমনটা মৃত্যুপথ পথযাত্রী আরও একটু বাচার আশা করে।
ঝকঝকাঝক শব্দে এগিয়ে চলেছে ট্রেন। হঠাৎ একটা বাকে শহর ছেড়ে সবুজের ভিতর হারিয়ে গেলাম। ছন্দময় ঝকঝকাঝক শব্দের সাথে হাওরের বর্ধিত পানিতে ডুবে থাকা ফলসের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলল কালনী এক্সপ্রেস। রং-ঢং, হাসি-ঠাট্টার ছন্দে এগিয়ে চলছে ট্রেন।
৩.
হঠাৎ হৃদয়ের নাম্বার থেকে ফোন এল সজীবদা'র ফোন। বেচারা শেষ পর্যন্ত স্টেসনে এসেছে কিন্তু ট্রেন ততক্ষণে অনেকদূর।
ওকে বলা হল, বাস করে শ্রীঙ্গল চলে আসতে। কিন্তু সে আমাদের সঙ্গটা মিস করতে চাচ্ছিল না। হৃদয় তার হৃদয়ের জোর দিলে ছুটল সামনের পরবর্তী স্টেশনে। কিন্তুু পাচ মিনিটের ব্যাবধানে স্টেশন ছেড়ে ট্রেন যথারীতি সামনের দিকে। তখন পর্যন্ত আমরা নিশ্চত না হৃদয় আমাদের সাথে যোগ দিবে কি না।
যেহেতু সে তার দায়িত্বে গাফিলতি করেছে তারও শিক্ষা হওয়া উচিত বলেই আমরা বলাবলি করছিলাম কিন্তু আমরা বিশেষ করে চাইছিলাম ও যেন শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথে যোগ দিতে পারে।
৪.
শ্রীমঙ্গল নেমে সবাই নাস্তার কাজটা সেরে ফেললাম। ঐখান থেকে হামহামের বাড়া সম্পর্কে একটা আইডিয়া নিলাম। ইতিমধ্য হৃদয় অন্য একটা ট্রেন ধরে প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। হৃদয়কে দেখা মাত্রই আমরা ওকে সোহাগ (কেলানী) করে বরণ করে নিলাম। দৌড়ের উপরে ওকে নাস্তা খাওয়ার মাঝে তিন চাকার CNG নামক প্রাইভেট কার ভাড়া করা হল। পানি, হালকা খাবার-দাবার ও প্রয়োজনী কিছু কেনাকাটার পরে গাড়ি ছুটে চলল হামহামের পথে।
হোটেল গ্রান্ড সুলতানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের বিতর্ক শুরু হল।
বিতর্কের বিষয়ঃ গ্রান্ড সুলতান নামেই ফাইব স্টার, ফ্যাসিলিটিতে না।
পক্ষেঃ হাসান, বিপক্ষে সজীবদা।
আমরা বাকীরা বিচারক।
লাউয়া ছড়ার মাঝখানে দিয়ে তুমুল গতিতে এগিয়ে চলছে গাড়ি আর সেই সাথে বিতর্কসভা।
শেষ পর্যন্ত সিনিওর বিচারকরা অমিমাংসিতভাবে বিতর্ক স্থগিতাদেশ দিল।
আমার কলাবাগান পাড়া নামক এক জায়গায় নামলাম।
যাত্রা কিন্তু তখনো শেষ হয়নি। এরপরই শুরু হয় মূলযাত্রা।
5.
কলাবাগান পাড়া থেকে বাকিটা হাটার পথ। কোন গ্রামের মেঠোপথ ধরে নয়, পাহাড়ের ভিতর দিয়ে। জংলী পাহাড়। ওখানে গিয়ে সবাই বাশের লাঠি কিনে নিলাম। এই বাশের শক্ত লাঠি পাহাড়ে চড়তে অনেক সাহায্য করে। যে কোন মুহুর্তে জোঁক হামলা করতে পারে। সেজন্য বাসা থেকেই লবণ নিয়ে এসেছি। একজন স্থানীয় গাইড নিলাম আমরা। যদিও আমাদের মাঝে শুধুমাত্র রাহাত ভাই'ই আগে এসেছে তবু তিনি নিজে গাইডের দায়িত্বে স্থানীয় একজনকেই নিলেন।
আমরা নাম এন্টি করে ডুকে পড়লামে জঙ্গল আর পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে। এ যেন আপ আর ডাউনের খেলা। শুনেছি সবচে' বড় পাহাড়টি ৭০০ ফুট উচু। তের চৌদ্দটির মত পাহাড় আছে। পথিমধ্যে মাঝে মাঝে অনেকের সাথে দেখা হচ্ছিল যারা ইতিমধ্য অভিযান শেষ করে ফিরছে। এদের চেহারার দেখেই বুঝা যাচ্ছিল তাদের পরিশ্রমটা। হটাতে হাটতে মনে হয় এ পথ বুঝি আর কখনো শেষ হবে না। সুযোগ পেলেই জোঁক হাতে বা পায়ের দিকে বসে কিস করছে। একটু চুলকানির মত ভাব হয়। চুলকানির পিচ্ছিল লাগে তখনই বুঝা যায় এটা কিসের চুলকানি। যখনই গাইডকে বলা হচ্ছিল আর কত দূর, আর কত দূর? গাইডের সেই একই উত্তর এই তো সামনেই। গাইডের কোন কসুর নেই। কেননা, গাইডকে আগেই উত্তরটা রাহাত ভাই শিখিয়ে দিয়েছিলেন। মধ্য দুপুরের ভ্যাপসা গরম যখন শরীরকে ক্রমশই নিস্তেজতার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল তখনই আমরা একটা আকাঙ্খিত শব্দ শুনতে পেলাম। জলের স্রোতর শব্দ। তখনো প্রায় ৭০০ ফুটের মত উচ্চতায়। নিচে সবুজের বিস্তৃতঅঞ্চল। আমার তখন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কে জানে মরার জন্য এর চেয়ে সুন্দর জায়গায় জীবনে যেতে পারব কি না!
পাহাড় বেয়ে নামতেই হাম হামের লেজের দেখা পেলাম। আমরা হাত-মুখ ভিজিয়ে নিলাম। এই জল ধরা ধরে এগুতে থাকলাম। ততক্ষণে সব ক্লান্তি বিজয় করে ফেলেছি আমরা। তীর ধরে হাটতে হাটতে আমরা হঠাতই দেখলাম প্রকৃতিকর্তার এক অপূর্বতা আমাদের সামনে। হাম হামের যে সৌন্দর্যরূপ দেখেছি সেটার বর্ণণা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভম নয়। শুধু এতটুকুই বলতে পারি, ফেরার পথে আমাদের একবারও মনে হয়নি আমরা কোন পরিশ্রম করছি। চোখের সামনে যেন একটা স্বপ্নময় মোহ চলে এসেছিল সেই মোহনায় আমরা ভেসে ভেসে চলেছি একটা পাহাড় থেকে আরেকটা পাহাড়ে।
বি.দ্রঃ ধৈর্যের অভাবে অনেক কিছুই লিখতে পারিনি বলে দুঃখিত।